অনমনীয় সড়কের বিভিন্ন উপাংশ সমূহ চিহ্নিতকরণ আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং – ১ [ Civil Engineerng Drawing – 1 ]” এর “সড়কের গঠন” অধ্যায় এর পাঠের অন্তর্ভুক্ত।
অনমনীয় সড়কের বিভিন্ন উপাংশ সমূহ চিহ্নিতকরণ
৭.৪ অনমনীয় সড়কের বিভিন্ন উপাংশ সমূহ চিহ্নিতকরণ (Different components of rigid pavement) :
অনমনীয় পেভমেন্ট অর্থাৎ কংক্রিট রোড নিম্নের উপাংশসমূহের সমন্বয়ে গঠিত ঃ
১। সাব-গ্রেড (Sub-grade)
২। সাব-বেস কোর্স (Sub-base course)
৩। সিমেন্টে কংক্রিট পেভমেন্ট (Cement concrete pavement) |
উপাংশসমূহের বর্ণনা নির্মাণ পদ্ধতিতে করা হলো-
সিমেন্ট কংক্রিট ও আরসিসি রোডের নির্মাণের ধাপসমূহ-
১। সাব-গ্রেড প্রস্তুতকরণ (Preparation of Sub-grade)
২। সাব-বেস প্রস্তুতকরণ (Preparation of Sub-base)
৩। ফর্মা স্থাপন (Fixing of forma
৪। মালামাল ব্যাচিং এবং মিশ্রণ (Batching of materials and mixing)
৫। কংক্রিট ঢালাই (Carrying and placing concrete)
৬। দৃঢ়বদ্ধ এবং সমাপনী কাজ (Compaction and finishing)
৭। ফ্লোটিং এবং এজিং (Floating and edging)
৮। কিউরিং (Curing)
৯। যানবাহন চলাচলের জন্য রাস্তা উন্মুক্তকরণ।
সিমেন্ট কংক্রিট ও আরসিসি রোডের নির্মাণপদ্ধতি (Construction procedure of CC and RCC roads) ঃ কংক্রিট পেভমেন্টের নির্মাণকাজ সাধারণভাবে শুকনা মৌসুমে আরম্ভ করাই শ্রেয়। এতে প্রস্তুতকৃত রাস্তার বেসকোর্স সবদিক দিয়ে ভালো থাকে। নির্মাণকাজকে নিম্নলিখিত ধাপে ভাগ করা যেতে পারে ঃ
(ক) সাব-গ্রেড এবং সাব-বেস প্রস্তুতকরণ ঃ মসৃণ এবং শক্ত পৃষ্ঠতল পাওয়ার জন্য ভিত্তির স্তরকে বিন্যাস (Graded) করতে হবে এবং দৃঢ়বদ্ধ করতে হবে। সাব-গ্রেডের প্রকৃত লেভেল এবং গ্রেড অথবা প্রোফাইল পেতে হলে সাব-গ্রেডকে ভালোভাবে ১০ টন রোলারের সাহায্যে মসৃণ এবং সামঞ্জস্যভাবে (Uniformly) দৃঢ়বদ্ধ করতে হবে। পেভমেন্ট যদি মাটির বর্তমান পৃষ্ঠতলেই নির্মাণ করতে হয় তাহলে অন্তত ১৫ সেমি গভীরতা পর্যন্ত মাটিকে খনন করতে হবে। খননের পর পুনরায় মাটি ভরাট করার প্রোফাইল -শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে মাটিকে দৃঢ়বদ্ধ করতে হবে।
সাধারণত কংক্রিট পেভমেন্টের মোট প্রশস্ততার উভয় পার্শ্বে অতিরিক্ত 30 সেমি চ করে বেশি গ্রন্থের সাব-গ্রেড তৈরি করতে হবে। প্রাথমিকভাবে ৭.৫ সেমি পুরুত্বের একটি বালির স্তর সাব-গ্রেডের উপর ছড়িয়ে দিতে হবে এবং উত্তমরূপে, ভিজাতে হবে। ফলে বালি কর্তৃক কংক্রিট অভ্যন্তরস্থ পানি শোষিত হবে না। এ স্তরকে ইনসুলেটিং লেয়ার (Insulating layer) বলা হয়। অনেক সময় বালির পরিবর্তে পানিরোধক কাগজ (পলিথিন পেপার) ব্যবহৃত হয়। ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের বেলায় সাব-গ্রেডের ভারবহন ক্ষমতা (Bearing capacity) সর্বত্র একই রকমের হওয়া উচিত।
তবে রিজিড বা সিমেন্ট কংক্রিট রাস্তার ক্ষেত্রে ভারবহন ক্ষমতা ততো বেশি না হলেও চলে। সাব-গ্রেড নরম হলে এবং মাটির ভারবহন ক্ষমতা কম হলে সাব-বেস এর প্রয়োজন হয়। এমতাবস্থায় ভালোভাবে দৃঢ়বদ্ধ সাব-বেস এর উপরে কংক্রিট পেভমেন্ট স্থাপন করা হয়। সাব-বেস এর পুরুত্ব সাধারণত 15 সেমি এর বেশি হওয়া উচিত নয়। সাব-বেস হিসাবে ইটের সোলিং সয়েল, গ্র্যাভেল মিক্সার, ওয়াটার বাউন্ড ম্যাকাডাম স্তর ব্যবহার করা যেতে পারে।
(খ) ফর্মা স্থাপন ঃ পেভমেন্টের উভয় কিনারায় পেভমেন্টের পুরুত্বের সমান উচ্চতাবিশিষ্ট কাঠ বা লোহার শিট ব্যবহার করতে হবে, যাতে পেভমেন্টের জন্য ঢালাইকৃত কংক্রিট নির্দিষ্ট আকৃতিতে আটকে রাখা যায়। ফর্মা সেকশন করে ৩ মিটার পর পর তৈরি করা হয়। যে সকল রাস্তায় আড়াআড়ি জোড়া থাকা প্রয়োজন সেখানেও অনুরূপভাবে কাঠ বসিয়ে দিতে হবে। রাস্তা যদি লম্বালম্বি স্ট্রিপে ঢালাই করা হয় তবে দুইটি লেনের মাঝখানে অনুরূপভাবে কাঠ বা লোহার শিট বসিয়ে জোড়ার উপযুক্ত স্থান এবং পেভমেন্টের উচ্চতা নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ফর্মার পুরুত্ব কমপক্ষে পেভমেন্টের পুরুত্বের এক-তৃতীয়াংশ হওয়া উচিত। প্রত্যেকটি ফর্মাকে খাড়া এবং লম্বিকভাবে বসাতে হবে এবং ১.২ মিটার কেন্দ্রিক দূরত্বে খুঁটির ঠেস (Support) দিতে হবে। খুঁটির সেকশন ৫ সেমি x ৫ সেমি X ৬০ সেমি হবে। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঢালাই কাজ চালানো হলে অবশ্যই স্টিল ফর্মা ব্যবহার করতে হবে। স্টিল ফর্মা ৩ মি. লম্বা হবে এবং ৩ টি স্পাইক (Spike) এর সাহায্যে ফর্মাকে সঠিক অবস্থানে খাড়া করে রাখতে হবে। সঠিক অবস্থানে ফর্মা স্থাপনের পর এবং ঢালাই এর পূর্বে ডিজাইন এবং ড্রয়িং মোতাবেক ফর্মাকে সঠিকভাবে নিরীক্ষা করে নিতে হবে। কংক্রিট ঢালাই করার ২৪ ঘণ্টা পর ফর্মা উঠিয়ে ফেলতে হবে।
(গ) কংক্রিট মিশ্রণ ঃ কংক্রিট মিশ্রণের পূর্বে কোর্স ও ফাইন অ্যাগ্রিগেট ব্যবহার উপযোগী কি না তা যাচাই করে নিতে হবে। কোর্স অ্যাগ্রিগেটগুলো পরিষ্কার, ঘনকসদৃশ, কোনাকার ও উপযুক্ত গ্রেডিং সম্পন্ন হতে হবে। কোর্স অ্যাগ্রিগেট মিশ্রণের পূর্বে উত্তমরূপে পানি দ্বারা ধৌত করতে হবে, যাতে অ্যাগ্রিগেট মিশ্রণ হতে পানি শোষণের সুযোগ না থাকে। মিশ্রণের অনুপাত ঠিক রাখা একান্ত প্রয়োজন। তবে কোর্স ও ফাইন অ্যাগ্রিগেটের সূক্ষ্মতার গুণাঙ্কের (Fineness modulus) উপর মিশ্রণের অনুপাত অনেকটা নির্ভরশীল।
পেভমেন্ট যদি এক কোর্সবিশিষ্ট হয় তখন মিশ্রণের ১ : : ২ হলে পেভমেন্টের শক্তি ভালো পাওয়া যায়। যদি পেভমেন্ট দুই কোর্সে ঢালাই করা হয়, তাহলে বেস কোর্সে কংক্রিট মিশ্রণের অনুপাত ১ : ২৫ : ৪ এবং ওয়্যারিং কোর্সের কংক্রিট মিশ্রণের অনুপাত ১: ১ : – হবে। কংক্রিটের মিশ্রণ মিক্সচার মেশিনের সাহায্যে করা হয়। তবে এটি হাতেও করা যায় ।
(ঘ) কংক্রিট ঢালাই ঃ কংক্রিট মিশ্রণের পর পর ভিজা কংক্রিটকে স্থাপন করা প্রয়োজন। ফর্মার ভিতরে কংক্রিট মিশ্রণ একদিক হতে ভরাট করতে হবে। কংক্রিট মিশ্রণ যাতে এক জায়গায় স্তূপীকৃত না হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। যাতে জোরে ঢালা না হয় সেদিকেও নজর রাখা প্রয়োজন। ফর্মার ভিতর ফর্মার উচ্চতার চেয়ে ২ সেমি হতে ২.৫ সেমি বেশি কংক্রিট স্থাপন করতে হয়, যাতে দৃঢ়বদ্ধ হওয়ার পর সঠিক পুরুত্ব পাওয়া যায়। যেহেতু আধ ঘণ্টা পর কংক্রিট জমতে শুরু করে সেহেতু বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ঢালাই করা ঠিক হবে না।
(ঙ) দৃঢ়বদ্ধ করা ঃ কংক্রিট স্থাপনের পর একে দৃঢ়বদ্ধ করা হয়। ক্যাম্বার টেমপ্লেটের সাহায্যে সাধারণত দৃঢ়বদ্ধ কাজ সম্পন্ন করা হয়। এর উভয় প্রান্তে দুইটি হাতল বা হ্যান্ডেল থাকে। এ হাতল দুইটি দ্বারা দুইজন লোক সমান তালে আড়াআড়িভাবে একবার সামনে ও একবার পিছনে পিটিয়ে দৃঢ়বদ্ধ করতে থাকে। পিটানো শেষ হলে ক্যাম্বার ও চাপ নিরীক্ষা করে নিতে হয়।
চ) সমাপনী কাজ ঃ কাঠের ফ্লোট অথবা মোটা বেল্ট আড়াআড়িভাবে স্থাপন করে উভয় পার্শ্বে দুইজন লোক সামনে পিছনে টানতে থাকে এবং সে সাথে রাস্তার দৈর্ঘ্য বরাবরও এগিয়ে যায়। এর ফলে রাস্তার পিচ্ছিলতা দূর হয় এবং যানবাহন চলাচলের মসৃণতা বজায় থাকে।
(ছ) এজিং ঃ কংক্রিট প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল হওয়ার পূর্বে স্ল্যাবের ধার বরাবর খাড়াভাবে ইট বসাতে হয়। এজিং এর ইটগুলো মাটিতে ভালোভাবে বসাতে হয়। ফর্মা হিসাবে কাঠ বা লোহার শিট এর পরিবর্তেও এজিং করা যায়।
(জ) কিউরিং ঃ পেভমেন্ট ঢালাইয়ের পর কংক্রিটের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য ঢালাইয়ের ২৪ ঘণ্টা পর ১৪ দিন হতে ২৮ দিন পর্যন্ত পেভমেন্ট ভিজিয়ে রাখা হয়। এ প্রক্রিয়াকে কিউরিং করা যায়—
(ক) মাটির আইল তৈরি করে পেভমেন্টের উপর পানি জমা করে।
(খ) কচুরিপানা, খড়কুটা ইত্যাদি ভিজা অবস্থায় পেভমেন্টের উপর ছড়িয়ে দিয়ে।
(গ) পেভমেন্টের উপর কাঠের গুঁড়া ছড়িয়ে দিয়ে সর্বদা ভিজা রেখে ।
(ঘ) পেভমেন্টের উপর ভিজা বস্তা, চট ইত্যাদি বিছিয়ে দিয়ে।
(ঝ) যানবাহন চলাচলের জন্য রাস্তাকে উন্মুক্ত করে দেয়া ঃ কিউরিং শেষ হওয়ার পর রাস্তার উপরিভাগ পরিষ্কার করে জয়েন্টগুলোতে আলকাতরা বা বিটুমেন গরম করে দিতে হয়। এ সমস্ত কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর রাস্তাকে যানবাহনের জন্য খুলে দেয়া হয় ।
আরও পড়ুন: