আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় সিভিল কন্সট্রাকশনের পাথর । শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
Table of Contents
সিভিল কন্সট্রাকশনের পাথর
পাথর
পাথর সাধারণ ভূ-ত্বক ও এর রূপান্তর বিশেষ। বহুবিদ খনিজ পদার্থের জটিল রাসায়নিক যৌগ হলো পাথর।প্রকৃতিতে প্রাপ্ত শিলা হতে নির্মাণ পাথর পাওয়া যায়। পাথরকে নির্মাণ সামগ্রীর রাজা বলা হয়।
পাথরের শ্রেণিবিভাগ
প্রকৃতিতে প্রাপ্ত পাথর তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যথাঃ
(ক) ভূ-তাত্ত্বিক শ্রেণিবিভাগ (Geological classification)
(খ) ভৌত শ্রেণিবিভাগ (Physical classification)
(গ) রাসায়নিক শ্রেণিবিভাগ (Chemical classification)
(ক) ভূ-তাত্ত্বিক শ্রেণিবিভাগ:
এই শ্রেণিবিভাগ অনুসারে পাথরকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়:
১। আগ্নেয় শিলা (Igneous rocks) :
ম্যাগনা (গলিত পাথর) ঠান্ডা হয়ে এই শিলা গঠিত হয়। যেমন:- গ্রানাইট, ব্যাসল্ট, ডুলেরাইট।
২। পাললিক শিলা (Sedimentary rocks) :
পুরাতন শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে স্তূপকৃত হয়ে গঠিত হয়। যেমন- গ্রাভেল, স্যান্ডস্টোন, জিপসাম।
৩। রূপারিত শিলা (Metamorphic rocks) :
উক্ত দুই প্রকার শিলা প্রচণ্ড তাপে ও চাপে রুপান্তরের ফলে বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়ে এই প্রকার শিলা গঠিত হয়। যেমন- কোয়ার্টাইজ, প্লেট, মার্বেল।
(খ) ভৌত শ্রেণিবিভাগ :
এই শ্রেণিবিভাগ শিলার সাধারণ গঠনের উপর নির্ভর করে করা হয়। যথা-
১. স্তরীভূত শিলা (Stratified Rocks) :
বিভিন্ন তলে স্তরীভূত অবস্থায় থাকে এবং সহজেই এই তলে এদেরকে আলাদা করা যায়। যেমন- পাললিক শিলা
২. অন্তরীভূত শিলা (Unstratified rocks) :
এদের গঠন স্ফটিক দানাদার বা দৃঢ় দানাদার হয়ে থাকে। যেমন- আগ্নেয় এবং পাললিক শিলা ভূ-ত্বকের নড়াচড়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৩. পত্র-সদৃশ শিলা (Foliated Rocks):
কোনো একটি নির্দিষ্ট দিকে ভেঙে পড়ার প্রবণতা থাকে। যেমন- রূপান্তরিত শিলা।
(গ) রাসায়নিক শ্রেণিবিভাগ:
এই শ্রেণিবিভাগ অনুসারে পাথরকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. বালিজাত শিলা (Siliceous rocks) সিলিকার পরিমাণ বেশি থাকে। খুব শক্ত, মজবুত এবং আবহাওয়াজনিত কারণে সহজে প্রভাবিত হয় না। যেমন- গ্রানাইট, কোয়ার্টাইজ।
২. কাদাজাত শিলা (Argillaceous Rocks) কাদার পরিমাণ বেশি থেকে। খুব ঘন, দৃঢ় অথবা নরমও হতে পারে। যেমন- প্লেট, ল্যাটেরাইট।
৩. চুনাজাত শিলা (Calcareous rocks) ক্যালসিয়াম কার্বনেট বেশি পরিমাণে থাকে। স্থায়িত্ব পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে। যেমন- মার্বেল, চুনাপাথর।
পাথরের ব্যবহার
১। কাঠামো:
পাথর ভিত্তি, দেয়াল, কলাম, লিন্টেল, আর্চ, ছাদ, ফ্লোর, ডিপিসি ইত্যাদি কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
২। ফেস ওয়ার্ক:
যে কোনো কাঠামোকে পাথর জমকালো আকর্ষণীয় করে তোলে। দেয়ালকে ইট দ্বারা তৈরি করা হয় এবং ফেসিং নির্দিষ্ট রঙের পাথর দ্বারা করা হয়। একে কম্পোজিট ম্যাশনারি বলে।
৩। পেভিং স্টোন:
বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং কলকারখানার ইমারতের ফ্লোর ঢাকতে এ ধরনের পাথর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া রাস্তা, ফুটপাত ইত্যাদির পেভিংও করা হয়।
৪। মৌলিক সামগ্রী:
পাথর ভেঙে সিমেন্ট কংক্রিট, রাস্তার খোয়া, ক্যালকারিয়াস সিমেন্ট, কৃত্রিম পাথর, হলো ব্লক (hollow block) তৈরির একটি মৌলিক উপাদানে রূপান্তর করা হয় ।

৫। বিবিধ:
পাথর অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন রেলওয়ের ব্যালাস্ট, ব্লাস্ট ফারনেসের ফ্লাস্ক, সেতু, পিয়ার (pier), এবাটমেন্ট(abutment), রিটেইনিং ওয়াল (retaining wall), লাইট হাউজ (light house), ড্যাম (dam) ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।
আমাদের দেশে আকার (size) হিসাবে তিন ধরনের পাথর, স্টোন চিপস হিসেবে কংক্রিট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যথা- ২৫ মি মি (পি-গ্রাভেল) আকার, ২০ মি মি আকার এবং ২০ মি মি এর নীচের আকার ।
পাথরের বৈশিষ্ট্য
কোন বিশেষ কাজের জন্য কোন পাথর উপযুক্ত তা নিশ্চিত করতে যে কোনো ব্যক্তিকে পাথরের গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। নিম্নে বিভিন্ন প্রকার পাথরের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:-
গ্রানাইট (Granite)
১। আগ্নেয় শিলা
২। কোয়ার্টজ (দানাদার সিলিকা), ফেলেস্পার (কেলাসিত), অভ্র এবং খনিজ দিয়ে গঠিত
৩। ধূসর, সবুজ, বাদামি, গোলাপি এবং লাল রঙে পাওয়া যায়।
৪। দৃঢ় এবং মজবুত
১। আবহাওয়াজনিত প্রভাবের বিরুদ্ধে বেশি মাত্রায় প্রতিবন্ধক।
২। এর গুণগত মান অনুযায়ী ভিতরের উপাদানসমুহের বিন্যাস (texture) পরিবর্তিত হয়।
৩। আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific gravity) ২.৬ থেকে ২.৭ এবং কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ ৭৫০ থেকে ১৩৫০ কেজি/সেমি
৪। কারুকার্য, রাস্তার খোয়া, রেলের ব্যালাস্ট, কংক্রিটের এগ্রিগেট, সেতু নির্মাণে, পিয়ার এবং সামুদ্রিক কাজ
ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয় ।
ব্যাসল্ট (Basalt)
১। আগ্নেয় শিলা।
২। লাল, হলুদ, ধূসর, বাদামি, গোলাপি, নীল এবং সবুজাভ কালো রঙে পাওয়া যায়।
৩। দৃঢ়, মজবুত এবং শক্ত।
৪। আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific gravity) ৩ এবং কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ ১৫৩০ থেকে ১৮৯০ কেজি/সেমি
৫। কারুকার্য, রেলের ব্যালাস্ট, কংক্রিটের এগ্রিগেট ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়।
বেলে পাথর (Sand Stone)
১। পাললিক শিলা।
২। বিভিন্ন গঠন আকৃতির যেমন চিকন দানা, মোটা দানা, দৃঢ় এবং সচ্ছিদ্রতা (porous)
৩। সাদা, সবুজ, নীল, কালো, হলুদ এবং লাল রং-এ পাওয়া যায়।
৪। আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific gravity) ২.৬৫ থেকে ২.৯৫
৫। কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ ৬৫০ থেকে ৭০০ কেজি/ সেমি
৬। যাঁতা, শান বাঁধানো ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়।
চুনাপাথর (Lime Stone)
১। পাললিক শিলা।
২। বিভিন্ন গঠন আকৃতিতে পাওয়া যায় যা রং, দৃঢ়তা, উপাদানের স্তর বিন্যাস, কাঠিন্যতা এবং মজবুতিতে পার্থক্য হয়ে থাকে।
৩। আপেক্ষিক গুরুত্ব ২.০ থেকে ২.৮ এবং ক্রাসিং স্ট্রেস্থ ৫০০ থেকে ৫৫০ কেজি/ সেমি
৪ । দৃঢ় চুনাপাত্র, দানাদার চুনাপাথর, ম্যাগনেসিয়া চুনাপাথর, ক্যালকার চুনাপাথর ইত্যাদি প্রকারের হয়। ৫। পেভিং, রাস্তার খোরা ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়।
মার্কেল (Marble)
১। রপান্তরিত শিলা।
২। উচ্চ দৃঢ়তা সম্পন্ন।
৩। সাদা, সবুজ, নীল, কালো, হলুদ এবং লাল রং-এ পাওয়া যায়।
৪। আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific gravity) 2.৬৫ থেকে ২.৯৫
৫। কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ ৭০০ থেকে ১৩০০ কেজি / সেমি
৬। কারুকার্য, দেয়াল লাইনিং, কলাম, পাইল, টেবিল ক্লাব, টাইলড ফ্লোর, সিঁড়ির ধাপ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়।
প্লেট (Slate)
১। রূপান্তরিত শিলা।
২। ভরল শোষণ করে না, দৃঢ় চিকন দানা বিশিষ্ট এবং যখন আঘাত করা হয় তখন ধাতব শব্দ হয়।
৩। কালো, ধূসর, কালচে নীল এবং লালচে বাদামি রঙে পাওয়া যায়।
৪। ড্যাম প্রুফ কোর্স (ডিপিসি), পেডিং ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয় ।
পাথরের প্রাপ্তি স্থান
প্রকৃতিতে বিভিন্ন পাথর পাওয়া যায়। এর মধ্যে চুনাপাথর সিলেটের ভোলাগঞ্জে, দিনাজপুর এবং বগুড়ার খনিগুলোতে পাওয়া যায়। স্লেট এবং ল্যাটেরাইট চট্টগ্রামে, সিঙ্গেল বোল্ডার ও নুড়িপাথর সিলেটের জাফলং, কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ জেলায় পাওয়া যায়।
আরও দেখুনঃ