আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় দেয়ালের গাঁথুনিতে ব্যবহৃত বন্ড । শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
Table of Contents
দেয়ালের গাঁথুনিতে ব্যবহৃত বন্ড
স্থায়িত্ব, সৌন্দর্য, আর্থিক দিক এবং ভারবহন ক্ষমতা ইত্যাদি কারণে দেয়াল গাঁথুনিতে বন্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ অধ্যায়ে দেয়ালের গাঁথুনিতে ব্যবহৃত বন্ড সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
বন্ড
গাঁথুনিতে ইট সাজানোর বিভিন্ন পদ্ধতিকে বন্ড বলে। এতে ইটকে এভাবে জোড়া দেওয়া হয় যাতে উপরের বা নিচের দুই স্তরের খাড়া জোড়া একই খাড়া রেখায় না থাকে।
বন্ডের প্রয়োজনীয়তা
১। কাঠামো স্থায়ী ও শক্তিশালী করা।
২। শেয়ার বল প্রতিরোধ করা।
৩। গাঁথুনিতে উলম্ব বা খাড়া জোড়া পরিহার করা।
৪। নির্মাণকাজ দ্রুত করা।
৫। দেয়ালের পৃষ্ঠদেশে কারুকার্য করা বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা।
৬। দেয়ালের উপর আসা সকল প্রকার লোড বা ভার সমভাবে বণ্টন করা।
৭। ইটের মধ্যকার বন্ধন সুদৃঢ় করা।
বন্ডের প্রকারভেদ
গাঁথুনিতে ব্যবহৃত বন্ডকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা হয়। যথা:-
১। স্ট্রেচার বন্ড (stretcher bond)
২। হেডার বন্ড (header bond)
৩। ইংলিশ বন্ড (english bond)
৪। ফ্লেমিশ বন্ড (fleimsh bond
৫। গার্ডেন ওয়াল (garden bond)
৬। রেকিং বন্ড (raking bond)
৭। ডাচ বন্ড (dutch bond)
৮। ব্রিক-অন-এজ বন্ড (brick on edge bond)
৯। ইংলিশ ক্রস বন্ড (english cross bond)
১০। ফেসিং বন্ড (facing bond)
বিভিন্ন প্রকার বন্ডে ইট সাজানোর পদ্ধতি
১। স্ট্রেচার বন্ড:
এই প্রকার বন্ডে প্রতিটি স্তরে ইটে দেয়ালের দৈর্ঘ্যের বরাবরে স্ট্রেচার হিসেবে স্থাপন করা হয়। স্ট্রেচার হিসেবে ব্যবহৃত এক ইট বিশিষ্ট পার্টিশন দেয়ালে এই বন্ড ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের বন্ডে গাঁথুনিতে যথাযথ বন্ড সৃষ্টি হয় না। অর্ধ ইট পুরুত্বের বেশি দেয়ালে এই বন্ড ব্যবহার করা হয় না। সাধারণত ১২.৫ সে.মি. পুরু দেয়াল নির্মাণে এই বন্ড ব্যবহার করা হয়।
২। হেডার বন্ড:
এই পদ্ধতিতে প্রতিটি স্তরে ইটকে হেডার হিসেবে স্থাপন করা হয়। এক ইটের দৈর্ঘ্যের সমান পুরুত্বের দেয়ালে এই বন্ড ব্যবহার করা হয়। বাঁকা দেয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রে এই বন্ড বেশি উপযোগী।
৩। ইংলিশ বন্ড:
এই প্রকার বন্ডে এক স্তর হেডারের উপর অপর স্তর স্ট্রেচার ইট স্থাপন করা হয় অর্থাৎ এক স্তরে ইটগুলো লম্বালম্বিভাবে এবং অপর স্তরে ইটগুলো আড়াআড়িভাবে স্থাপন করা হয়। এই বন্ড খুবই শক্তিশালী এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। খাড়া জোড়াগুলো যাতে একই রেখায় না পড়ে সেজন্য হেডার স্তরের প্রথম হেডার ইটের পর একটি কুইন ক্লোজার বসাতে হয়।
৪। ফ্লেমিশ বন্ডঃ
এই বন্ডে একই স্তরে একটি ইট লম্বালম্বি ও পরেরটি আড়াআড়ি করে পাশাপাশি স্থাপন করা হয়। ফ্লেমিশ বন্ডে প্রতিটি স্তরে হেডার ইটের কেন্দ্র বরাবর এর উপরের এবং নিচের স্তরের স্ট্রেচার ইটের কেন্দ্র থাকবে। প্রতিটি হেডারের দুই পাশে একটি করে স্ট্রেচার ইট থাকবে। ইংলিশ বন্ড থেকে এটি দেখতে সুন্দর হলেও অধিক সংখ্যক ক্লোজার ব্যবহার করার কারণে এই বন্ড দুর্বল হয়। ফ্লেমিশ বন্ড দুই প্রকার। যথা- ক. ডাবল ফ্লেমিশ বন্ড; খ. সিঙ্গেল ফ্লেমিশ বন্ড।
৫। গার্ডেন ওয়াল বন্ড:
গার্ডেন ওয়াল, কম্পাউন্ড ওয়াল ও বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণের জন্য যে বন্ড ব্যবহৃত হয় তাকে গার্ডেন ওয়াল বন্ড বলে। সাধারণত ২৫০ মি.মি বা এক ইট পুরু দেয়ালের ক্ষেত্রে এই বক্ত ব্যবহার করা হয়। দেয়ালের উচ্চতা দুই মিটারের বেশি হবে না। ইংলিশ বা ফ্লেমিশ উভয় বন্ডে দেয়াল গাঁথা যায় বলে এই বস্তুকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
ক. ইংলিশ গার্ডেন ওয়াল বন্ড
খ. ফ্লেমিশ গার্ডেন ওয়াল বন্ড।
৬। রেকিং বন্ড:
অধিক লম্বা দেয়ালের ক্ষেত্রে এই বন্ড ব্যবহৃত হয়। লম্বা হওয়ার কারণে এর আনু ভূমিক দৃঢ়তা কম। দেয়াল ফেসিং এবং ব্যাকিং-এর মধ্যে স্ট্রেচার এর চেয়ে হেডার বেশি ব্যবহৃত হয়। ত্রুটি দূর করতে ৬ বা ৮ স্তর ইট গাঁথার পর একটি রেকিং বন্ড ব্যবহার করা হয়। রেকিং মানে কোনাকুনি। মাঝের ইটগুলো কোনাকুনিভাবে স্থাপন করা হয়। ফলে উপরের ও নিচের স্তরগুলোর বন্ধন একই সরলরেখায় থাকে না। রেকিং বন্ড দুই প্রকার। যথা-
ক. হেরিং বোন বন্ড
খ. ডায়াগনাল বন্ড।
৭। ডাচ বন্ডঃ
এই বন্ড ইংলিশ বন্ডেরই রূপান্তর মাত্র এবং এর ব্যবহারে দেয়ালের কর্নার (কোনা) শক্তিশালী হয়। এই বন্ডের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো:
ক. ইংলিশ বন্ডের মতো এক স্তর হেডার ও এক স্তর স্ট্রেচার হবে।
খ. স্ট্রেচার স্তরে ৩ থেকে ৪টি ব্যাট ব্যবহৃত হবে।
গ. প্রতি অলটারনেট স্ট্রেচার স্তরের পরেই একটি করে ব্যাট বসাতে হবে।
৮। ব্রিক-অন-এজ বন্ডঃ
এই জাতীয় বন্ডে ইটকে সমান্তরালে বা আনুভূমিকভাবে স্থাপনের পরিবর্তে প্রান্তের উপর স্থাপন করা হয়। এই বন্ডে গাথা দেয়ালে ইট ও মসলা কম লাগে তাই আর্থিকভাবে লাভজনক। শক্তি কম বলে পার্টিশন দেয়াল, কমপাউন্ড দেয়াল ও গার্ডেন দেয়ালে ব্যবহৃত হয়।
৯। ইংলিশ ক্রস বন্ড:
এ বন্ড ডাচ বন্ডের মতো এবং ইংলিশ বন্ডের অনুরূপ। দেয়াল পৃষ্ঠের কারুকার্য ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। এই বন্ডের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো।
ক. এক স্তর হেডার ও এক স্তর স্ট্রেচার।
খ. প্রত্যেক অলটারনেট স্ট্রেচার স্তরে কুইন স্ট্রেচারের পরেই একটি হেডার ব্যবহৃত হয়।

১০। ফেসিং বন্ডঃ
ফেসিং ও ব্যাকিং-এ ভিন্ন ভিন্ন পুরুত্বের ইট ব্যবহার করা হয়। গাঁথুনিতে কয়েকটি স্ট্রেচার স্তর ব্যবহার করার পর একটি হেডার স্তর নির্মাণ করা হয়। পর পর দুই হেডার স্তরের মধ্যবর্তী দূরত্ব হবে ফেসিং ও ব্যাকিং ইটের পুরুত্বের ল.সা.গু-র সমান। যদি মসলাসহ ফেসিং ইটের পুরুত্ব ১০ সে. মি এবং ব্যাকিং ইটের পুরুত্ব ৮ সে. মি হয় তাহলে হেডার স্তরে মধ্যবর্তী দূরত্ব হবে ৪০ সে. মি কারণ ১০ ও ৮ এর ল.সা.গু ৪০।
ক্লোজার (closure)
নির্দিষ্টভাবে ভাঙা ইটের টুকরা বিশেষ, যার একটি লম্বা পাশ অক্ষত থাকে তাকে ক্লোজার বলে। ইটের গাঁথুনিতে যাতে খাড়াভাবে জোড়া না পড়ে সেজন্য ক্লোজার ব্যবহার করা হয়। ক্লোজার তৈরিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায় না, রাজমিস্ত্রি কাজের সময় বাশুলী দ্বারা কেটে প্রয়োজনীয় আকার ও আকৃতির ক্লোজার তৈরি করে।
ক্লোজারের প্রকারভেদ
নিচে বিভিন্ন প্রকার ক্লোজারের নাম উলেখ করা হলো:
ক. কুইন ক্লোজার (queen closure)
খ. কিং ক্লোজার (king closure)
গ. বেভেলড ক্লোজার (bevelled closure)
ঘ. মিটারড ক্লোজার (mitred closure)
ক. কুইন ক্লোজার: ইটকে লম্বালম্বিভাবে কেটে সমান দুইভাবে ভাগ করে যে ক্লোজার তৈরি করা হয় তাকে কুইন ক্লোজার বলে। আসলে অর্ধেক প্রন্থ বিশিষ্ট পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ইটই কুইন ক্লোজার।
খ. কিং ক্লোজার: পূর্ণ ইটের প্রান্তের প্রন্থের অর্ধেক কোণাকার করে কেটে ফেললে যে ক্লোজার পাওয়া যায় তাকে কিং ক্লোজার বলে। অন্য কথায় লম্বপাশ অক্ষত রেখে ত্রিভুজাকার একটি খণ্ড কেটে নিলেই কিং ক্লোজার পাওয়া যাবে। ত্রিভুজাকার খণ্ডটির অতিভুজ হবে ইটের দৈর্ঘ্যের মধ্য হতে প্রন্থের মধ্য পর্যন্ত। এই ক্লোজার সাধারণত জোড়ের সন্তোষজনক প্রতিস্থাপনের জন্য দরজা-জানালার পাশে ব্যবহার করা হয়।
গ. বেভেলড ক্লোজার: এটি দেখতে অনেকটা কিং ক্লোজারের মতো। এই ক্লোজারের এক প্রান্তে পূর্ণ প্রস্থ ও অন্য প্রান্তে অর্ধেক গ্রন্থ থাকবে। এর চেহারা এক প্রান্তে ক্লোজার ও অন্য প্রান্তে হেডার।
ঘ. মিটারড ক্লোডার: ৪৫° হতে ৬০০ কোণে একটি ইটের পূর্ণ প্রস্থকে কেটে মিটারড ক্লোজার তৈরি করা যায়। গাঁথুনিতে দেয়ালের কোণায় বা সংযোগস্থলে এই ক্লোজার ব্যবহার করা হয়।
বন্ডের ব্যবহার ক্ষেত্র
নিচে বিভিন্ন প্রকার বন্ডের ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।
ক্রমিক নং | বন্ডের নাম | বন্ডের ব্যবহার ক্ষেত্র |
১. | স্ট্রেচার বন্ড | পার্টিশান দেয়াল, স্লিপার দেয়াল, ডিভিশনে দেয়াল ও চিমনি স্টেকে। |
২. | হেডার বক্ত | বক্রাকৃতির দেয়ালে ও ভিত্তির ফুটিং-এ। |
৩. | ইংলিশ বন্ড | অর্ধ ইট পুরুত্বের অধিক পুরু যে কোন দেয়ালে |
8 | ফ্লেমিশ বন্ড | দেয়ালে মূল্যবান ইট দিয়ে কারুকার্য ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে। |
৫ | ফেসিং বন্ড | দেয়ালে ফেসিং ও ব্যাকিং-এ যদি বিভিন্ন প্রকার ইট ব্যবহৃত হয়। |
৬. | ইংলিশ ক্রস বন্ড | দেয়ালের পৃষ্ঠদেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে। |
৭. | ব্রিক-এজ বন্ড | গার্ডেন ওয়াল, পার্টিশন ওয়াল, কম্পাউন্ড ওয়াল, রাস্তার সলিং-এ। |
৮ | ডাচ বক্ত | দেয়ালের কোণায়। |
৯. | রেকিং বন্ড | রাস্তার সলিং-এ। |
১০. | গার্ডেন ওয়াল বন্ড | সীমানা দেয়াল, গার্ডেন দেয়াল ও কম্পাউন্ড দেয়াল। |
আরও দেখুনঃ