আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – সিভিল কন্সট্রাকশনের প্লাস্টারিং যা অধ্যায়-৭ এর সিভিল কন্সট্রাকশন ২ এ অন্তভুক্ত। শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
Table of Contents
সিভিল কন্সট্রাকশনের প্লাস্টারিং
প্লাস্টার (Plaster)
সাধারণত বাড়ি বা দেওয়াল নির্মাণের পর কিছু সৌন্দর্যবর্ধক কাজ করা হয়। প্লাস্টার এ জাতীয় কাজের একটি। পানি, বালি ও বন্ধনী পদার্থ(সিমেন্ট বা চুন) সহযোগে তৈরি মসলা (Morter) দ্বারা কোন গাত্রে যেমনঃ- বিম, কলাম, দেওয়াল, ছাদ বা ছাদের তলায় যে পাতলা আবরণ দেওয়া হয় তাকে পলেস্তরা বা প্লাস্টার (Plaster) বলে। এই কাজ করাকে বলা হয় ‘প্লাস্টারিং’। প্লাস্টার করার পর অবশ্যই উত্তমরূপে ‘কিউরিং’ করতে হয়।
প্লাস্টারিং এর উদ্দেশ্য
প্লাস্টার করার বা প্লাস্টারিং এর উদ্দেশ্যগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১) অসমতল গাত্রতলকে সমতল করা এবং বাইরের পানি প্রবেশ রোধ করা।
২) নির্মাণ কাজে গাত্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা এবং চুনকাম ও ডিস্টেমপার প্রয়োগের জন্য গাত্রতল তৈরি করা।
৩) কক্ষের ভিতরের দেওয়াল ধুলাবালি মুক্ত রেখে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় সহায়তা করা।
৪) নির্মিত অবকাঠামোর গাত্রতলকে আর্দ্র বা স্যাঁতস্যাঁতে হওয়া থেকে রক্ষা করা।
৫) দেওয়ালের জোড়া (Joint) ও ত্রুটিপূর্ণ গাত্রতল ঢেকে ফেলা।
প্লাস্টারের প্রকারভেদ (Classification of plaster)
নিম্নে বিভিন্ন প্রকার প্লাস্টারের নাম উল্লেখ করা হলো। উল্লেখ্য বর্তমানে লাইম প্লাস্টার (Lime plaster) ও সিমেন্ট প্লাস্টার (Cement plaster) ছাড়া অন্যান্য প্লাস্টারের তেমন ব্যবহার নেই
১) চুন প্লাস্টার (Lime plaster)
২) সুরকি প্লাস্টার (Surki plaster)
৩) চুন, সুরকি প্লাস্টার (Lime-Surki plaster)
৪) চুনের পুটি (Lime putty)
৫) সিমেন্ট প্লাস্টার (Cement plaster)
৬) জিপসাম প্লাস্টার (Gypsum plaster)
৭) মোজাইক প্লাস্টার (Mosaic Plaster)
৮) মোগল প্লাস্টার (Moghal plaster)
৯) কাদার প্লাস্টার (Mud plaster)
বিভিন্ন প্রকার প্লাস্টারের উপাদান ও অনুপাত
চুন বালি প্লাস্টার (Lime plaster)
পাথুরে চুনে প্রথমে পানি মিশিয়ে উত্তমরূপে ফুটিয়ে নিতে হবে। চুনে যদি মাটি বা কাঁকরের টুকরা থাকে তাহলে বেছে ফেলে দিতে হবে। এরপর ফুটানো চুনকে পানিতে মিশিয়ে নাড়তে হবে। তখন চুন আস্তে আস্তে নিচে থেতিয়ে পড়বে। এখন উপর থেকে পানিটা ফেলে দিয়ে নিচে জমানো মাখনের মতো চুন নিয়ে প্রয়োজন মতো বালি যোগ করতে হবে। এই জাতীয় প্লাস্টারে একভাগ বালি এবং একভাগ চুন ব্যবহার করা হয়। এর সাথে কিছু সিমেন্ট মেশালে উত্তম ফল পাওয়া যায়। এই চুন বালির মসলা দ্বারা প্লাস্টার করার পদ্ধতি সিমেন্ট মসলার অনুরূপ। শুধু কিউরিং এর কাজ সাতদিনের পরিবর্তে চারদিন করলেই চলবে।
সিমেন্ট বালির প্লাস্টার (Cement plaster)
প্লাস্টারের কাজে ব্যবহৃত বালি কংক্রিটে ব্যবহৃত বালির মতো মোটা দানার হলে ভালো না হলেও ক্ষতি নেই। তবে অতি মিহি দানার বালি ব্যবহার করা ঠিক হবে না। বালিতে বিদ্যমান অপদ্রব্য (Foreign materials) যথাঃ- কাঁকর, গাছের শিকড়, ও মাটি থাকলে তা প্রথমে চালুনি দিয়ে চেলে নিতে হবে নতুবা পানিতে ধুয়ে নিতে হবে।
প্লাস্টারের পুরুত্ব কত হবে বা সিমেন্ট বালি অনুপাত কি হবে তা কাজের গুরুত্বের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত দালানে ১: ৬, ড্রেনে ১:৪, রিজার্ভ ট্যাংক এবং সেপটিক ট্যাংক ইত্যাদিতে ১:৩ অনুপাতে সিমেন্ট-বালি ব্যবহার করা হয়। মসলা তৈরিতে পানি-সিমেন্ট অনুপাত যথাযথভাবে মেনে চলা উচিৎ, কারণ এটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবহৃত পানির পরিমাণ ও গুণাগুণের উপর প্লাস্টারের শক্তি অনেকাংশে নির্ভরশীল। সাধারণত প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের জন্য ৫.৫ থেকে ৭ গ্যালন পানি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
প্রথমে সিমেন্ট ও বালি অনুপাত অনুযায়ী মেপে একটি নিশ্ছিদ্র প্লাটফর্মে শুকনো অবস্থায় কোদাল বা বেলচা দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। মিশ্রণ এমন হবে যেন রং সুষম হয়। মিশ্রণ শেষে তাকে কোদাল বা বেলচা দ্বারা স্তূপাকার করে মাঝখানে কিছুটা গর্ত করে নিতে হবে। আস্তে আস্তে গর্তে পানি দিলে মিশ্রণ তা শুষে নিবে। শুষে নেওয়ার কারণে মিশ্রণ ক্রমশ নরম হতে থাকবে।
পানি দেওয়ার সাথে সাথে চারদিক থেকে উপাদানগুলো মাঝখানের দিকে তুলে দিয়ে গর্তের পাড়কে উচু করতে হবে। পানি ভিতরে প্রবেশ করার জন্য কোদাল দিয়ে আলগা করে দিতে হয়। পানি ধীরে ধীরে সংযোজনের ফলে এবং উপাদানগুলো বার বার ওলট পালট করে দেওয়ায় সুষম ও সঠিক মসলা তৈরি হবে।
সাধারণত ২৫০ মি মি দেওয়ালের বাইরের গায়ে ১২ মি মি এবং ভিতরের গায়ে ১৯ মি মি প্লাস্টার দেওয়া হয়। ১২৫ মি মি বা ৩৭৫ মি মি দেওয়ালের উভয় পার্শ্বে ১২ মি মি পুরু প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়। সিলিং, সানশেড, লিনটেল ও ছাদে ৬ মি মি পুরু প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়।
গ্লাস্টারের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি
নিয়ে প্লাস্টারের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাজিন্ন তালিকা দেওয়া হলোঃ
১) কোদাল
২) কর্ণি
৩) বেলচা
৪) উষা
৫) কড়াই
৬) উপকরণ মাপার বাজ
৭) তাম
৮) বালতি
৯) পাস্থা
১০) বগ
১১) বালি চালুনি
নতুন ও পুরাতন গাত্রগুদে প্লান্টার প্রয়োপ
প্লাস্টারের স্থায়িত্ব নির্ভর করে পাতল ছৈরি ও সুমুঢ় বন্ধনের উপর। প্লাস্টার প্রয়োগের পূর্বে নিজে বর্ণিত পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করে গাত্রজলে প্রভুভ করা উচিৎ।
১) নতুন দেওয়াল পাঁখার পর যদি ক্ষেত্রবিশেষ ইটের উষ্ণতা দেওয়াল থেকে বের হয়ে থাকে ভাষলে তা কেটে সমান করতে হবে। এতে মঙ্গলা কম খরচ হবে।
২) ইন্দ্রের জোড়াগুলো বরাবর ১০ থেকে ২০ মি মি পঞ্জীর করে দাগ কেটে নিজে হবে। পঁধুনি করার সময় খাদ আঁচড়ে রাখা হয়ে থাকে তাহলে দাগ কাটার দরকার নাই। দাগ কাটার পত্র মজ্বলা ও পুরাতন মসলা কেরে মুছে নিম্নে হবে।
৩) সেওয়ালের পারে অবস্থিত বিভিন্ন রকবেন্ত দাগ যুক্ত অংশ নায়কেলের ছোবড়ায় ঘ্রাণ হারা যবে পরিক্ষায় করে নিতে হবে।
৪) পুরাতন সেওয়ালে প্রাস্টার করতে হলে প্রথমে আগেকার প্লান্টায় কর্ণি বা হাতুড়ি দ্বারা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এরপর ব্রাশ বা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। পানি দিয়ে দেওয়ালকে সুছে বা ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
৫) পুরাতন দেওয়ালে যদি শ্যাওলা থাকে বা রং বিবর্ণ হয়ে যায়, তাহলে তারের ব্রাশ দিয়ে ঐ সব তুলে ফেলছে হবে।
৬) শেষ পর্যায়ে কাজ শুরু করায় পূর্বে দেওয়ালটিকে পানি যারা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। ভেজা দেওয়াল সামান্য ভেজা থাকতে প্লান্টারের কাজ শুরু করক্ষে হবে।
৭) দেওয়ালের পাত্রে সর্বত্রই প্লাস্টারের পুরুক্ষ সমান রাখা জরুরি। এ কাজটি যথাযথভাবে সমাধা করার জন্য পাঁব্রতলে প্রয়োজনীয় উচ্চকায় প্লাস্টারের ফালি তৈরি করে নিতে হবে। প্লাস্টার করার সময় উক্ত কালিগুলোর উচ্চতার সাথে মিল চেখে প্লান্টায় কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
প্রথমে তৈরি মসলা কড়াইতে করে কাজের জায়গায় নিতে হবে। কর্ণি দ্বারা মসলাকে দেওয়ালের গায়ে সজোরে লাগাতে হবে। পরে ঊষার সাহায্যে এই মসলাকে দেওয়ালের গায়ে (পরিমাণ মতো জায়গায়) লেপন করতে হবে। লেপন করার পর পাট্টার সাহায্যে লেপন করা প্লাস্টারকে মসৃণ ও সমতল করে দিতে হবে।
দেওয়ালে সব জায়গায় যেন প্লাস্টারর গভীরতা বা পুরুত্ব সমান থাকে সেজন্য ২ থেকে ৩ মিটার পর পর খাড়া ও লম্বালম্বিভাবে ১৫০ মিমি x ১৫০ মি. মি. ফালি (Strip) তৈরি করতে হবে। ফালির পুরুত্ব প্লাস্টারের জন্য নির্ধারিত পুরুত্বের সমান হবে। প্লাস্টারের কাজ চালিয়ে যাওয়ার সময় মনে রাখতে হবে যে ফালির উপর পাট্টা ফেলে দেওয়ালে প্রয়োগকৃত প্লাস্টারের উচ্চতা যাচাই করে নিতে হবে। প্লাস্টারের পুরুত্ব ফালির পুরুত্বের চেয়ে বেশি হলে পাট্টা দিয়ে ঘষে অতিরিক্ত মসলা সরিয়ে ফেলতে হবে এবং কম হলে আরও মসলা যোগ করে মসৃণ করতে হবে।
১২ মিমি ও ৬ মিমি পুরু প্লাস্টার একস্তরে লেপন করতে হবে। বেশি পুরুত্বের প্লান্টার একাধিক স্তরে প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম স্তর ১৩ মি মি পুরুত্বে প্রয়োগ করার পর প্রাথমিক জমাট বাঁধার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। জমাট বাঁধার পর দ্বিতীয় স্তরটি ৬ মি মি পুরুত্বে লেপন করে পাট্টা দ্বারা মসৃণ ও সমতল করে দিতে হবে।
প্লাস্টারের দোষত্রুটি
প্লাস্টারের মসলা তৈরির আধ ঘণ্টার মধ্যে কাজে ব্যবহার করা উচিৎ, অন্যথায় মসলা জমাট বেঁধে যাবে। জমাট বাঁধা মসলা প্লাস্টারে ব্যবহার করলে তা কিছুদিনের মধ্যেই ঝরে পড়বে। মসলা তৈরির সময় সঠিক তারল্য রক্ষা করা জরুরি। উত্তম প্লাস্টারের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ। যথাঃ
১) ব্যবহৃত গাত্রতলে অবশ্যই দৃঢ়বদ্ধভাবে লেগে থাকতে হবে।
২) শুকানোর পর ব্যবহৃত গাত্রতলে আয়তনে কম বা বেশি হতে পারবে না।
৩) লাইম প্লাস্টারের ক্ষেত্রে তার গায়ে দানাদার চুন থাকতে পারবে না। এ জাতীয় দানাদার চুন থাকলে বাতাসের আর্দ্রতা শোষণ করে গাত্রতল নষ্ট করে ফেলবে।

প্লাস্টারের কিউরিং পদ্ধতি
প্লাস্টার চুড়ান্ত জমাট বাঁধার পর পানিসিক্ত (Curing) করা জরুরি। কিউরিং না করলে দেওয়ালের রং সাদাটে হয়ে যাবে এবং ভিতরে ফাঁকা থাকবে। সিমেন্ট-বালির প্লাস্টার হলে কমপক্ষে ৭ দিন কিউরিং করতে হবে। চটের বস্তা দেওয়ালের গায়ে লাগিয়ে পানিসিক্ত করলে কিউরিং সহজ হবে। অথবা পানি পাইপ দিয়ে জেটিং এর মাধ্যমে কিউরিং করা যায়।
অনুশীলনী
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। প্লাস্টারিং কাকে বলে?
২। প্লান্টারের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির নাম লেখ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। প্লাস্টার কত প্রকার ও কি কি।
২। প্লাস্টারের উদ্দেশ্য বর্ণনা কর।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বিভিন্ন প্রকার প্লান্টারের উপাদান ও অনুপাত বর্ণনা কর। কিউরিং পদ্ধতি কি?
২। নতুন ও পুরাতন গাত্রতলে প্লাস্টার প্রয়োগের কৌশল বর্ণনা কর। প্লাস্টারের দোষত্রুটি উল্লেখ কর।
আরও দেখুন :