শিকল জরিপে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি | সার্ভেয়িং- ১

শিকল জরিপে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আজকের ক্লাসের আলোচ্য বিষয়। “শিকল জরিপে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি [ Equipment Used In Chain Survey ]” এই ক্লাসটি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের, “ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং [ Diploma in Civil Engineering ]”, সার্ভেয়িং- ১, ৩য় সেমিস্টার [ Surveying- 1, 3rd Semester ] বিষয়ের, ৩য় অধ্যায়ের [ Chapter 3 ] পাঠ।

 

শিকল জরিপে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি

 

ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে বিভিন্ন বস্তুর প্রকৃত অবস্থান আপেক্ষিক উচ্চতা দিক, রৈখিক ও কৌনিক দূরত্ব পরিমাপের মাধ্যমে একটি স্কেল অনুসরণ করে সমতল কাগজে উপস্থাপন করার পদ্ধতিকে জরিপ বলে।

 

ক) গান্টার্স শিকল (Gunter’s chain) :

এডমন্ড গান্টার এ শিকলের আবিষ্কারক। এটা 66 ফুট লম্বা এবং 100টি সমান ভাগে বিভক্ত। প্রতি ভাগের দৈর্ঘ্য 0.66 ফুট বা 7.92 ইঞ্চি, প্রতি ভাগকে এক লিঙ্ক (Link) বলা হয়। [চিত্র ঃ ৩.২ (ক)] শিকলটির প্রান্তদ্বয়ে দুটি হাতল আছে। হাতলের সাথে শিকলটি সুইভেল (Swivel) জোড়ায় সংযোজিত, যেন শিকলে মোচড় (Twist) না লাগে।

এক হাতলের প্রান্ত হতে অপর হাতলের প্রান্ত পর্যন্ত দূরত্ব সমান এক শিকল। শিকলটির অংশগুলো গ্যালভানাইজড্ মাইল্ড স্টিলের দণ্ডে তৈরি। এ শিকলে মাইল ও ফার্লং পরিমাপ করা সহজ (৪০ শিকল = 1 মাইল, 10 শিকল = 1 ফার্লং)। এ শিকল এ দেশে প্রচলিত চ ভূমি পরিমাপের ক্ষেত্রে অর্থাৎ একর, শতাংশে জমির পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। কেননা এ শিকলের 10 বর্গ শিকলে এক একর হয়। তাই এ সকল সুবিধার জন্য এ জাতীয় শিকল ভূমি জরিপকরগণ অধিক ব্যবহার করেন।

 

জরিপে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি

 

(খ) প্রকৌশল বা স্থপতি শিকল (Engineer’s chain) :

এ শিকল 100 ফুট লম্বা এবং 100 সমান ভাগে বিভক্ত। প্রতি ভাগের দৈর্ঘ্য ৷ ফুট এবং প্রতি ভাগকে এক লিংক বলা হয়। [চিত্র ঃ ৩.২(খ)] এটার দু’প্রান্তে দু’টি হাতল থাকে। এক হাতলের প্রান্ত হতে অপর হাতলের প্রান্ত পর্যন্ত দূরত্ব সমান এক শিকল। এটার হাতলের জোড়া সুইভেল (Swivel) জোড়া। এটার দ্বারা দৈর্ঘ্যের পরিমাপ ফুটে এবং ক্ষেত্রফল বর্গফুটে নির্ণয় করা সহজ। এফ.পি.এস. (F.P.S) পদ্ধতির প্রচলন কালে এটা ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের পরিমাপে ব্যবহার করা হতো।

 

 

(গ) মিটার শিকল (Metre chain) :

এগুলো গ্যালভানাইজড মাইল্ড স্টিলের তারে তৈরি। তারের ব্যাস 4 মিমি। এ জাতীয় শিকল 20 ও 30 মিটার দৈর্ঘ্যের এবং যথাক্রমে 100 ও 150 ভাগে বিভক্ত । প্রতি ভাগকে লিঙ্ক (Link) বলা হয়। প্রতি লিঙ্কের দৈর্ঘ্য 200 মিমি, প্রতি মিটার পর পর (5, 10, 15 মিটার ব্যতীত) ব্রাসের তৈরি অতিরিক্ত একটি ছোট রিং এবং প্রতি 5 মিটার পর পর M অক্ষর অঙ্কিত একটি অতিরিক্ত রিং সম্বলিত ফুলি দেয়া থাকে। 25 মিটার দৈর্ঘ্যের শিকলও পাওয়া যায়, তবে প্রতি লিঙ্কের দৈর্ঘ্য 250 মিমি এবং 100 লিঙ্কে বিভক্ত।

শিকলের প্রত্যেকটি লিঙ্কের প্রান্ত ভাগে ফাঁসের মতো বাঁকানো অংশের সহিত বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার রিং সংযোগে সংযোজিত। এতে শিকলের নমনীয়তা (Flexibility) রক্ষা পায় এবং শিকল প্যাচ খাওয়া হতে নিষ্কৃতি পায় । যদি শিকলের লিঙ্কগুলোর জোড়াগুলো খোলা অবস্থায় থাকে তবে ওয়েল্ডিং করে নেয়া উত্তম।

এতে জোড়ার প্রসারণ ঘটতে পারে না এবং শিকলের দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকে। শিকলকে টেনে নেয়ার জন্য এর উভয় প্রান্তে ব্রাসের তৈরি হাতল লাগান থাকে। এক হাতলের বহিঃপ্রান্ত হতে অপর হাতলের বহিঃপ্রান্ত পর্যন্ত দূরত্বকে এক শিকল ধরা হয়। শিকলের হাতলদ্বয় সুইভেল জোড়ায় সংযোজিত। এতে শিকল মোচড় খাওয়া (Twist) হতে রক্ষা পায়। শিকলের এক লিংক বলতে দুটি ধারাবাহিক কেন্দ্রীয় রিং এর একটির কেন্দ্র হতে অপরটির কেন্দ্র পর্যন্ত দৈর্ঘ্যকে বুঝায় । [চিত্র ঃ ৩.২(গ)]। প্রান্তীয় লিংকে হাতলের দৈর্ঘ্যও অন্তর্ভুক্ত।

হাতলের বহিঃপৃষ্ঠে তীর (Arrow) এর ব্যাসের অর্ধেক গভীরতায় গ্রুভ কাটা থাকে যেন প্রতি শিকল পর পর তীর বসালে কোনো ভ্রান্তি না আসে। শিকলের ফুলি বা ট্যাগ (tag)-গুলোতে দূরত্বের চিহ্ন দেয়া থাকে, যেন সহজেই পাঠ গ্রহণ করা যায়।সচরাচর ফুলির লেখা অথবা ফুলির দাঁতের সংখ্যা হতে সহজেই দূরত্বের পরিমাণ জানা যায়।

 

Google_news_logo
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

(ঘ) রেঞ্জিং রড (Ranging rod) :

রেঞ্জিং রড প্রধানত দু’ ধরনের কাজ করে থাকে। (১) স্টেশন বিন্দু চিহ্নিতকরণ ও (২) রেখাকে সোজাকরণ । এগুলো ভালোমানের সিজন করা (Seasoned) কাঠের তৈরি। সচরাচর সেগুন, শিশু, পাইন ও দেবদারু কাঠ দিয়ে রেঞ্জিং রড তৈরি করা হয়। এগুলোর প্রস্থচ্ছেদ বৃত্তাকার বা অষ্টভুজাকৃতির হয়ে থাকে এবং ব্যাস সাধারণত 3 সেমি। এগুলোর পোঁতা অংশের জন্য 15 সেমি দৈর্ঘ্যের লোহার নাল (Shoe) লাগানো হয়, যেন সহজে মাটিতে পোঁতা যায় এবং পোতার সময় ফেটে না যায়। এগুলো সচরাচর 2 বা 3 মি. লম্বা হয়ে থাকে এবং এগুলোতে 0.2 মি. দৈর্ঘ্যের দাগ দেয়া থাকে।

সহজে নজরে পড়ার জন্য দাগগুলোতে ধারাবাহিকভাবে একটির পর একটি সাদা ও কালো অথবা লাল ও সাদা অথবা, লাল, সাদা, কালো রঙের প্রলেপ দিয়ে দেয়া হয়। দূরত্ব অধিক হলে এগুলোর শীর্ষে 25 সেমি বর্গাকার পতাকা আটকে দেয়া হয় । পতাকা আটকে দেয়া রেঞ্জিং রড ঝাণ্ডি নামে পরিচিত।

 

 

(ঙ) ক্রস স্টাফ (Cross staff) :

কোনো বিন্দু হতে কোনো রেখার উপর লম্ব তৈরিকরণ অথবা কোনো রেখার কোনো নির্ধারিত বিন্দুতে লম্ব তৈরিকরণের জন্য ক্রস স্টাফ ব্যবহৃত হয়। এগুলো প্রধানত তিন ধরনের হতে পারে, যথা—(১) ওপেন ক্রস স্টাফ (Open cross staff) (২) ফ্রেন্স ক্রস স্টাফ (French cross staff)  (৩) অ্যাডজাস্টেবল ক্রস স্টাফ (Adjustables cross staff) । এগুলোর মধ্যে ওপেন ক্রস স্টাফ (Open cross staff) সচরাচর ব্যবহৃত হয়। এটা খুবই সাধারণ গঠনের। এটি দু’টি অংশের সমন্বয়ে গঠিত, যথা—(১) ‘হেড’ (Head) ও (২) ‘লেগ’ (Leg) । এর ‘লেগ’টি মাটিতে পোঁতার জন্য ব্যবহৃত হয়।

‘হেড’টিতে দু’জোড়া চিত্রানুরূপ খাড়া লম্বা সরু ছিদ্র (Slit) থাকে এবং এদের সংযোজিত সরল রেখাদ্বয় পরস্পরকে সমকোণে ছেদ করে। শিকল রেখার কোনো নির্ধারিত বিন্দুতে সমকোণ তৈরি করতে হলে প্রথমে ক্রস স্টাফটি ঐ বিন্দুতে ‘লেগ’ রেখে ঠিক উল্লম্বভাবে স্থাপন করে AB বা CD ছিদ্রপথে দৃষ্টিরেখা সামনের পোলের (Pole) সাথে মিলিয়ে নিতে হবে এবং অপর ছিদ্র দু’টি (যদি AB মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়ে থাকে তবে CD ছিদ্র) দৃষ্টিরেখার সাথে মিলিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে পোল (Pole) পুঁততে হবে। এখন পোল ও শিকল রেখার নির্ধারিত বিন্দুর সংযোজিত রেখা শিকল রেখার উপর লম্ব হবে।

আর যদি শিকল রেখার উপর কোনো নির্ধারিত বস্তু বা বিন্দু হতে লম্ব ফেলতে হয় তবে শিকল রেখার উপর ক্রস স্টাটি আগে- পিছে করে যে বিন্দুতে এক জোড়া ছিদ্রের (ধরি AB) দৃষ্টিরেখা শিকল রেখার সাথে এবং অপর জোড়া (CD) ছিদ্রের দৃষ্টিরেখা নির্ধারিত বস্তু বা বিন্দুর সাথে মিলে যাবে। শিকল রেখার ঐ বিন্দুতেই এ নির্ধারিত বস্তু বা বিন্দু লম্ব উৎপন্ন করবে।

 

 

 

(চ) অফসেট রড (Offset rod) ঃ

এগুলো রেঞ্জিং রডের মতো এবং 3 মিটার লম্বা। এগুলোতেও 0.2 মিটার দৈর্ঘ্যের দাগ দেয়া থাকে এবং রেঞ্জিং রডের মতো রং করে দেয়া হয়। তবে এদের মাথায় আংটা লাগানো থাকে যেন বেড়া বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধকের ছিদ্রপথে শিকলকে আংটায় ( hook) আটকিয়ে টেনে বা ঠেলে নেয়া যায়। এগুলোতে চক্ষু উচ্চতায় পরস্পর সমকোণে (দৈর্ঘ্য বরাবর) ছিদ্র লাল বা কালো ব্যান্ড করা থাকে। এতে অফসেট (offset) লাইন সংস্থাপনে সুবিধা হয়। ছোটখাটো অফসেট পরিমাপের ক্ষেত্রেও এগুলো ব্যবহার করা যায়।  রেঞ্জিং রড ও অফসেট রড যদিও দেখতে একই রকম, তবুও এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান।

 

 

(ছ) ওলন (Plumb-bob) :

ধাপ পদ্ধতিতে পাহাড়িয়া অঞ্চলে শিকল জরিপের সময় ওলন ব্যবহৃত হয় [চিত্র ঃ ৩.২ (ঞ)]। থিওডোলাইট বা এ ধরনের জরিপে ভূমিতে স্টেশন বিন্দুর অবস্থান চিহ্নিতকরণ ও রেঞ্জিং রড উল্লম্বভাবে স্থাপনের জন্যে ওলন ব্যবহৃত হয়।

 

 

(জ) তীর (Arrow) ঃ

এগুলো শক্ত ইস্পাতের তারের তৈরি [চিত্র ঃ ৩.২(ট)]। এগুলোকে মার্কিং পিন বা চেইনিং পিন (Marking pin or chaining pin)-ও বলা হয়। সাধারণত একটি শিকলের সাথে 10টি তীর সরবরাহ করা হয়।

এগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত তারের ব্যাস 4 মিমি হয়ে থাকে এবং এগুলো কালো রঙের এনামেল (Enamel) করা থাকে। তীরের দৈর্ঘ্য 250-500 মিমি হয়ে থাকে। সচরাচর ব্যবহৃত তীরের দৈর্ঘ্য 400 মিমি। এগুলোর এক প্রান্ত সুচালো থাকে যেন সহজে মাটিতে পোতা যায় এবং অপর প্রান্ত চিত্রানুরূপ ফাঁসের মতো যেন সহজে বহন করা যায়। শক্ত মাটিতে দাগ কাটার জন্যও তীরের সুচালো প্রান্ত ব্যবহার করা যায়।

 

(ঝ) টেপ (Tapes) ঃ

টেপ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রীতে তৈরি করা হয়। তবে নিচের পাঁচ শ্রেণির টেপই প্রধানত ব্যবহৃত হয়ে থাকে ঃ

১। কাপড় বা লিনেন টেপ (Cloth or linen tape )

২। ধাতব টেপ (Metallic tape ) ৩। ইস্পাত টেপ (Steel tape )

৪ । ইনভার টেপ (Invar tape )

৫। ফাইবার গ্লাসের ফিতা (Fiber glass tape)

 

(ঞ) অপটিক্যাল স্কয়ার (Optical Square) ও অপটিক্যাল প্রিজম স্কয়ার :

অপটিক্যাল স্কয়ার একটি সাধারণ গঠনের ছোট যন্ত্র । বৃত্তাকার বা অনেকটা গোঁজ আকৃতির, ধাতব পাতে নির্মিত বক্সে দুটি আয়না পরস্পর 45° কোণে স্থাপন করে এটি তৈরি করা হয়। শিকল জরিপে শিকল রেখার কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে লম্ব স্থাপনে বা কোনো বস্তু হতে শিকল রেখার লম্ব পাদমূল বিন্দু নির্ধারণে এটি ব্যবহৃত হয় [চিত্র : ৩.২(ত)]। অপটিক্যাল স্কয়ারের মতো একই নীতিতে তৈরি এবং একই কাজে ব্যবহার হয় অপটিক্যাল প্রিজম স্কয়ার। এ ছোট যন্ত্রটি বেশ আধুনিক এবং একক প্রিজমে তৈরি বিধায় এতে সমন্বয়ের দরকার হয় না। এতেও প্রতিফলন পৃষ্ঠ 45° কোণে স্থাপিত । তবে লাইন রেঞ্জার হিসাবেও এটি ব্যবহার করা যায়। এতে ধুলাবালি আটকানোর সুযোগ নাই।

 

 

(ট) হোয়াইটস্ (Whites) :

এগুলো বাঁশ বা কাঠের তৈরি, সচরাচর মাঠ থেকেই সংগৃহীত। যখন কার্যক্ষেত্রে রেঞ্জিং রড বা স্টেশন চিহ্নিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় খুঁটি না থাকে বা যখন সাধারণ খুঁটি বা পোল সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না, তখন 40 সেমি থেকে 1 মিটার দৈর্ঘ্যের কাঠ বা বাঁশের খণ্ডের এক প্রান্ত সুচালো ও অপর প্রান্ত কিয়ৎ পরিমাণ চিরে এতে সাদা কাগজ লাগিয়ে স্টেশনে পুঁতে দেয়া হয়। ফলে স্টেশন সহজে দৃষ্টিগোচর হয়। বিশেষ করে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত স্থানে কন্টুর বিন্দু চিহ্নিতকরণে এগুলোর ব্যবহার দেখা যায় ।

 

শিকল জরিপে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি নিয়ে বিস্তারিত :

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment